অভাজনের ইন্টারনেট প্রাইভেসি

আমার মত যারা নিতান্তই সাধারণ মানুষ, ইন্টারনেটে প্রাইভেসি নিয়ে তারা খুব একটা চিন্তা করেন না। কোনো একটা পণ্যের খোঁজ করার পর কী ফেসবুক, কী গুগল অ্যাড সবজায়গায় সেই পণ্য বা কাছাকাছি পণ্যের অ্যাড দেখে হয়ত বিরক্ত হন, হয়ত অবাক হন এই ভেবে যে আপনার পেছনে কেন এরা গুপ্তচরের মত লেগে আছে!? কেউ কেউ ‘অ্যাডব্লকার’-ও ইন্সটল করে থাকেন তারপর। কিন্তু এই পর্যন্তই। এরপর আমরা কমই ভাবি। আসুন, আমরা প্রাইভেসি নিয়ে ভাবার চেষ্টা করি একটু।

“কিন্তু আমার এত দিয়ে কী দরকার? আমি তো গোপন কিছু করছি না!” - প্রায় সকল সাধারণ মানুষ

আসলে আপনারও দরকার আছে। তার আগে একটা ঘটনা বলে নিই। একদিন আমার এক কলিগ বড়ভাই আর আমি অফিস থেকে বাসার পথে ফিরছিলাম। পথে আমাদের আলোচনা একসময় ক্রেডিট কার্ডে গড়ালো। দুজনেরই ইচ্ছে ক্রেডিট কার্ড নেওয়া। কোন ব্যাংক থেকে নিলে ভালো হয় ইত্যাদি আলোচনা করছিলাম হাঁটতে হাঁটতে। হঠাৎ করেই আমাদের পিছন থেকে এক ভদ্রলোক আমাদের আলোচনায় ‘যোগ’ দিলেন। “আপনারা ক্রেডিট কার্ড করতে চান? অমুক ব্যাংক থেকে করেন। কোথায় জব করেন? দেশের বাড়ি কোথায়? এই নেন আমার কার্ড, আমি কি আপনাদের নাম্বার পেতে পারি?” প্রথমত, আমরা একদম ভড়কিয়ে গিয়েছি। তারপর তারদিকে তাকালাম। ৩৫+, মধ্যবিত্তসুলভ ভুঁড়ি ও টাক, তার এমন মরিয়া চেষ্টা দেখে রীতিমত মায়া হবে আপনার। যাহোক, তাকে মোটামুটি বানিয়ে বলে (আমরা হার্ট করতে চাইনি), এবং যেহেতু কার্ড আছে কাছে, আমরা সুবিধা মত কল দেবো এমনটা আশ্বস্ত করে তাকে এড়িয়ে গেলাম।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আমার জায়গায় থাকলে আপনিও আমার মতই করতেন, বা আরো কড়া ভাবে কিছু বলতেন। নিশ্চয়ই একজন অজানা মানুষকে, তার উদ্দেশ্য যেমনই হোক আপনি নিজের নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বর দিবেন না। আসলে আমরা এই কাজটাই রোজ ইন্টারনেটে করি। অবশ্যই ফেসবুক-টুইটার এরা বড় কোম্পানি, সাধারণ ক্রেডিট কার্ডের দালাল না (ক্রেডিট কার্ডের এই দালালও কিন্তু আসলে একটা ব্যাংক-কে রিপ্রেজেন্ট করে)। আপনার স্বাভাবিকভাবেই এইসব কর্পোরেশনের ওপর আস্থা আছে। বস্তুত, তাদের আস্থা ভাঙার রেকর্ড তাদের মতই বড়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বলেন, বা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, সবাইকে তারা তথ্য দেয়। তথ্য, এই মুহুর্তে সবচেয়ে দামি মুদ্রা, আর আপনি-আমি রীতিমত এই মুদ্রার টাকশাল! এই পর্যায়ে আপনি বলবেন, আরে! আমি আর কীইবা করি? কয়েকটা লেইম পোস্ট, লুতুপুতু কবিতা নয়ত, নয়ত রেস্টুরেন্টে চেকআউট, সেলফি, এইতো…

আসলে, আপনার এইসব অতিসামন্য তথ্যই অনেকের অতি-দরকারি পুঁজি। আপনাকে তারা ইতমধ্যে পরিসংখ্যানের কতরকম তথ্যের কতরকম বিভাগে চিহ্নিত করে রেখেছে (এই বিভাগগুলোর একটা চলতি নাম হচ্ছে ‘বাকেট’) আপনার তা ধারনাও নেই। এইসব তথ্য তারা সাজিয়ে-গুছিয়ে কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে যেন তারা আপনার কাছে তাদের পণ্যগুলো বিক্রি করতে পারে।

এইখানেই শেষ না…

মেশিন লার্নিং (নাম তো সুনা-হি হোগা!) এই মুহুর্তে ইনফরমেশন টেকনোলজির জগতে একটা জনপ্রিয় প্রযুক্তি। সাদা কথায়, মেশিনকে অনেক অনেক ডাটা দেওয়া হয়, এবং মেশিন সেই ডাটা থেকে কোরিলেশনগুলো চিহ্নিত করে এবং পরবর্তীতে এই তথ্য কাজে লাগিয়ে প্রেডিক্ট করে। খুবই দারুণ প্রযুক্তি, বহুক্ষেত্রে এর সফল প্রয়োগ আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, প্রায় সমান, বা তারও বেশি ক্ষেত্রে এর খুব বাজে ব্যবহার আছে। দুটো উদাহরণ দিই। একটা হচ্ছে অ্যামাজনের কয়েকবছর আগপর্যন্ত ব্যবহৃত সিভি বাছাইয়ের প্রোগ্রাম।[^1](https://www.theguardian.com/technology/2018/oct/10/amazon-hiring-ai-gender-bias-recruiting-engine) এই প্রোগ্রামটি আগে যে তথ্য দিয়ে ট্রেইন করা হয়েছে তাতে তখনকার সময়ে মেয়েদের চাকরিতে না নেওয়ার যে বৈষম্য তা প্রকট ছিল। ফলে প্রোগ্রামটি নারী ক্যান্ডিডেটদের বাদ দিয়ে দিচ্ছিল। অ্যামাজন প্রথমে সফটওয়্যারটিকে ঠিক করার চেষ্টা করে, পরে বাদ দিয়ে দেয়।

আইন ব্যবস্থায় শাস্তি দেওয়ার আগে একটা বিষয় বিবেচনা করা হয়। সেটা হচ্ছে, অপরাধীর আবার অপরাধ করার সম্ভবনা কতটুকু। সেটা কম হলে শাস্তি কম হয়। এই সম্ভবনা বের করতে আমেরিকার কোর্টগুলোতে COMPAS[^2](https://en.wikipedia.org/wiki/COMPAS_(software)) নামে একটা সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। এই সফটওয়্যার আফ্রিকান-অ্যামেরিকানদের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। তার কারন হচ্ছে বিগত কয়েক-দশকে আফ্রিকান-আমেরিকানরা যে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে, সেই বৈষম্যমূলক আচরণ এই সফটওয়্যার তথ্য হিসেবে পেয়েছে।

সফটওয়্যার আসলে বৈষম্য করতে জানে না। সফটওয়্যার ‘বৈষম্য’ শব্দটাও অনুধাবন করতে পারে না। মানুষের বায়াসগুলোই সফটওয়্যারে সংক্রমিত হয়। মেশিন লার্নিং আসলে খুবই জটিল একটি ব্যবস্থা, এর ফলাফল আসলে কী হবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেডিক্টও করা যায় না। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে অর্থ উপার্জন। তাই তারা খুব একটা কেয়ারও করে না। এই বিষয়ে যদি আপনার আগ্রহ থাকে তাহলে Cathy O’neil এর Weapons of Math Destruction: How Big Data Increases Inequality and Threatens Democracy বইটা পড়তে পারেন।

ওই যে, আপনাকে বাকেটে ফেলে রাখে বলছিলাম না? এমনকি আপনাকে আপনার নিজের বাকেট থেকেই সব পোস্ট, অ্যাড ইত্যাদি দেখায়। অর্থাৎ, আপনি যে রাজনৈতিক দলের সমর্থক, হয়ত শুধু তাদের প্রপাগান্ডাই ফীডে পাবেন। বিপক্ষের মতামত কখনো চোখেই পড়বে না।

যখন আপনি নিজের প্রাইভেসি রাখেন না, তখন আসলে আপনি সবার ক্ষতি করেন।

আমি কনভিন্সড, কিন্তু আমার কী করা উচিত?

অবশ্যই আপনি ফেসবুক/ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি ছাড়া থাকতে পারবেন না, সেটা নিয়ে তাই কথা বলা অবান্তর। এটা বোঝা উচিত যে এইসব সার্ভিস বাজারের সাথে তুলনীয়। বাজারের ভীড়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুর সাথে মৃদুস্বরে কথা বললেও প্রাইভেসির যেমন নিশ্চয়তা নেই এগুল‌ো তেমন। সেটা বুঝে ব্যবহার করা উচিত।

কোম্পানিতে না, সফটওয়্যারে আস্থা রাখুন

কখনোই কোনো কোম্পানিকে বিশ্বাস করা ঠিক না। যেটা করা উচিত, সফটওয়্যারে আস্থা রাখা। এখন কোন সফটওয়্যারে আপনি আস্থা রাখতে পারেন? ওপেনসোর্স সফটওয়্যারে। ওপেনসোর্স সফটওয়্যার[^3](https://en.wikipedia.org/wiki/Open-source_software) হচ্ছে তেমন সফটওয়্যার যার সোর্সকোড উন্মুক্ত, অর্থাৎ তার ভেতরের কারিগরি আপনিও চাইলে দেখতে পারেন। আপনার এই বিষয়ে জ্ঞান না থাকলেও যাদের জ্ঞান আছে তারা কিন্তু এর সিকিউরিটির সমস্যাগুলো দ্রুতই বের করে ফেলে। কিন্তু ওপেনসোর্স না হলে আপনার তথ্য কী হচ্ছে সঠিক করে বলা মুশকিল। অর্থাৎ, মজিলা ফাউন্ডেশনকে বিশ্বাস না করলেও চলবে। ফায়ারফক্স একটি ওপেনসোর্স ব্রাউজার, আপনি এটাতে আস্থা রাখতে পারেন।

কিছু সফটওয়্যার ও সার্ভিস, যেগুলো আমার মতে আপনার ইন্টারনেট প্রাইভেসির জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখবে:

ব্রাউজার: মজিলা ফায়ারফক্স

ডেস্কটপে, অ্যানড্রয়েডে, আইওএস-এ সবজায়গায় ফায়ারফক্স পাবেন। এটি প্রায় সব বড় বড় ট্র্যাকারদের ব্লক করে। যেমন ফেসবুক, গুগল ইত্যাদি। ফলে আপনি বিভিন্ন সাইট থেকে ফেরার পর অনবরত যে অ্যাডগুলো দেখেন তা অনেকটাই কমে আসবে। তা ছাড়াও অন্যান্য প্রাইভেসি ফিচারের দিকে তাকালে ফায়ারফক্স অন্য ব্রাউজারদের থেকে অনেক এগিয়ে। ফায়ারফক্সের সাথে:

সার্চ ইঞ্জিন: DuckDuckGo

এই সার্চ ইঞ্জিনটি আপনার কোনো ডাটাই রাখে না। অন্যান্য সার্চ ফিচারও ভালো।

ইমেইল: Protonmail / Gmail + Mailvelope

ইমেইল জিনিসটা আসলে অনেক পুরনো। আগে এতে এনক্রিপশানের কোনো বালাই ছিল না। এখন খানিকটা আছে। কিন্তু তারপরেও জিমেইলের মত প্রোভাইডাররা নিজেরা কিন্তু আপনার মেইল পড়তে পারে। আপনি যদি একদম এনক্রিপ্টেড মেইল ব্যবহার করতে চান তাহলে প্রোটনমেইল আমার মত সবচেয়ে ভালো অপশান। ফ্রী একাউন্ট খোলা যায়।

কিন্তু আপনি যদি একান্তই জিমেইলটা ছাড়তে না চান, অন্তত, পাসওয়ার্ডের মত স্পর্শকাতর তথ্য শেয়ার করার সময় Mailvelope ব্যবহার করতে পারেন। এতে আপনি মেইলটির বডি এনক্রিপ্টেড করতে পারবেন।

ইন্সট্যান্ট মেসেজিং: টেলিগ্রাম, সিগন্যাল

দুটোই বেশ ভালো। তবে টেলিগ্রামে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশান বাই ডিফল্ট এনাবেলড্ না। এনাবেল করে নেওয়া ভালো।

আপনি যদি সাংবাদিক বা অ্যাক্টিভিস্ট হন…

আপনি যদি এমন পেশায় থাকেন যেখানে আপনার ওপর নজরদারি হতে পারে, ভালো হয় Tor Browser ব্যবহার করলে। টর আপনাকে নেয়ার-পারফেক্ট অ্যান‌োনিমিটি দেবে।

পাসওয়ার্ড

চেষ্টা করুন স্ট্রং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে, নিজের নাম, প্রেমিকার/প্রেমিকের নাম, কুকুর-বিড়ালের নাম, জন্মতারিখ ইত্যাদি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। পাসওয়ার্ড দুইরকম হয়:

তা ছাড়াও আপনি পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করতে পারেন (যেমন ফায়ারফক্স লকওয়াইজ)। পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের মাস্টার পাসওয়ার্ড অবশ্যই কঠিন হতে হবে। তারপর সবজায়গায় পাসওয়ার্ড ম্যানেজার দিয়ে পাসওয়ার্ড জেনারেট ও ফিল করবেন। মনে রাখার ঝামেলা নাই।